সচিব পদে হবে পদায়ন ॥ শূন্য থাকা ৮ জেলার ডিসি নিয়োগ ॥ রদবদল হবে এডিসি-ইউএনও
প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে আসছে আরও পরিবর্তন
আপলোড সময় :
২৯-০৯-২০২৪ ০৯:২০:২০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৭-১০-২০২৪ ০৬:১০:২২ অপরাহ্ন
বাংলা স্কুপ স্পেশাল:
জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে সামনে আসছে আরও পরিবর্তন। চলতি সপ্তাহেই কয়েকজন সচিব প্রত্যাহার ও নতুন পদায়ন হতে পারে। নতুন ডিসিদের কেউ সক্ষমতা প্রমাণ করতে না পারলে প্রত্যাহার হতে পারেন। শূন্য থাকা ৮ জেলার ডিসি নিয়োগও হবে দ্রুত। রদবদল হতে পারে এডিসি ও ইউএনও পদেও। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীত যাচাই করে যোগ্যদের নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে নিয়োগের পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলে ভুল বার্তা যাবে। জনপ্রশাসন সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান জানিয়েছেন, সচিব ও অধিদফতরের প্রধান পদে নতুন করে কিছু পদায়ন হবে। প্রত্যাহার হবেন কয়েকজন। সচিব মোখলেস উর রহমান জানান, প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে কঠোর সরকার। ১ অক্টোবর শুরু হচ্ছে প্রশাসন সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমও।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দেড় মাসেরও বেশি সময় পার হলেও জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরেনি। কর্মকর্তাদের কেউ ব্যস্ত পদোন্নতি নিয়ে, কেউ ব্যস্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে যেতে, আবার কেউ তদবির করছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) হতে। প্রায় প্রতিদিনই সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে ভিড় করছেন তদবিরকারী কর্মকর্তারা। প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে পেট্রোবাংলা, এলজিইডি, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলন করছেন। এতে ওই সব দপ্তরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে প্রশাসন সাজিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। সেই প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তবর্তী সরকার। এরইমধ্যে কয়েকজন সচিবকে ওসডি বা অবসরে পাঠানো হয়েছে। বাতিল হয়েছে ১১ সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। এতে কয়েকটি মন্ত্রণালয় এখন সচিব শূন্য। আবার বেশকিছু মন্ত্রণালয়ে থেকে গেছেন বিগত সময়ের সুবিধাভোগীরা। মাঠ প্রশাসনের চালক জেলা প্রশাসক বা ডিসিরা। ক্ষমতার পালাবদলে ৫১ জেলায় যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেছেন নতুনরা। অভিযোগ থাকায় নিয়োগের পরদিনই বাতিল হয় ৮ জেলার নতুন ডিসির নিয়োগ। তাই ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে এসব জেলা। আবার উপসচিব পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার ক্ষোভ ও অভিযোগ আছে নতুন ডিসি নিয়োগ নিয়ে। এ ব্যপারে সাবেক সচিব একে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, সিদ্ধান্ত নিলে বুঝে শুনে নেয়া উচিত। সিদ্ধান্ত নিলে আর পরিবর্তন না করা ভালো। পরিবর্তন করলে একটা খারাপ বার্তা যায়। সরকার গোছানোর চেষ্টা করছে। আমি মনে করি আগামী এক মাসের ভেতর সব গুছিয়ে ফেলবে।
জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোর বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞা বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে গতানুগতিক চিন্তা করলে হবে না। আবার সবার প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে। তবে সবার দাবি একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য সময় দিতে হবে।
মাঠ প্রশাসনেও একধরনের অস্থিরতা রয়েছে। যে কারণে প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত ৯ সেপ্টেম্বর ২৫ জেলায় এবং ১০ সেপ্টেম্বর ৩৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, কারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল এবং কাউকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করায় এখন সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব পদ খালি। এসব মন্ত্রণালয়ের কাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে প্রশাসনের ওপর এত চাপ তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছরে ব্যাপক দলীয়করণ, মেধা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের কারণে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সময় লাগবে।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জনপ্রশাসনে প্রথম বড় পদোন্নতি হয় গত ১৩ আগস্ট। ওই দিন ১১৭ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবকে উপসচিব করা হয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ২২৩ উপসচিবকে যুগ্ম সচিব করা হয়। এরপর ২৫ আগস্ট ১৩১ কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব করা হয়। সব মিলিয়ে ৮ আগস্ট থেকে অন্তর্র্বতী সরকার ৪৭১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে উপসচিব, এরপর যুগ্ম সচিব ও সর্বশেষ পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। ৫ আগস্টের আগেও তাঁরা ছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। চাকরির বাকি সময়ে পদোন্নতি হবে না—এমনটা নিশ্চিত জেনে অবসরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাঁরা। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কর্মকর্তাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এমন আলোচনাও আছে, অল্প সময়ের ব্যবধানে তিন ধাপে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এখন হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ পদে গিয়ে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাঁদের কারও কারও সমস্যা হতে পারে।
বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, অল্প সময়ে যাঁরা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন, তাঁদের উচিত হবে নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করা। তাঁরা যে যোগ্য ছিলেন, এখন কাজের মাধ্যমে তাঁদের প্রমাণ করতে হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিসিএস ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা খ ম কবিরুল ইসলাম দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তিন ধাপে পদোন্নতি পান। ১৩ আগস্টের আগপর্যন্ত তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব। পদোন্নতি পেয়ে তিনি এখন অতিরিক্ত সচিব। যদিও তাঁর ব্যাচের কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকজন সচিব হয়ে গেছেন। একইভাবে বিসিএস ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান দীর্ঘদিন ছিলেন পদোন্নতিবঞ্চিত। তাঁর পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে এত বছর পদোন্নতি পাননি। তাঁর ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা এখন সচিব। জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে মাহবুবুর রহমান এখন অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। খ ম কবিরুল ইসলাম ও মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা বলেন, বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় তাঁদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, বঞ্চিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি বঞ্চিত সেজে কিছু সুবিধাভোগী, বিতর্কিত ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যাঁর বিরুদ্ধে অপরাধে জড়ানোর অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা চলছে এমন কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। বিসিএস ১৫তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে তিন ধাপে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন এবার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে পরস্পর যোগসাজশে বিবিয়ান-২ বিদ্যুৎ প্রকল্পে ৩৩ একর জমি অধিগ্রহণে বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দেখিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। ওই ব্যাচের আরেকজন কর্মকর্তা তিন ধাপে পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী কিছু কর্মকর্তা অন্তর্বর্তী সরকারেও গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস) হয়েছেন। ওই দুজনের একজন বিসিএস ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের একান্ত সচিব ছিলেন। এ ছাড়া বিগত সরকারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন ছিলেন। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টার একান্ত সচিব হয়েছেন। এ নিয়ে সমালোচনা করছেন বিগত সময়ের বঞ্চিত কর্মকর্তারা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গত দেড় মাসে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে শক্তিশালী কোনো বার্তা বা নিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কাজে গতি আনতে হলে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে।
এএইচ/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স